‘গত তিন দিন আগে আমি তিন মণ আম কুরিয়ার করে পাঠিয়েছি ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। আমের সাইজ হবে তিনটায় এক কেজি, দেখতেও সুন্দর। খুব যত্নে প্যাকিং করে পাঠিয়েছি, ভাবছিলাম গ্রাহক খুশি হবে। কিন্তু গতকাল একজন গ্রাহক ফোন করে বললেন, আমের সাইজ ভালো, রঙও ভালো ছিল কিন্তু স্বাদ কম।আমি বিব্রত হয়েছি।কথাগুলো বলছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও মৌসুমি আম বিক্রেতা নাজিউর রহমান।তিনি আরও বলেন, ‘এই অভিযোগ আমার মতো আরও অনেক বিক্রেতার কাছে এসেছে। কিন্তু গত বছর আমি তিনশ মণ আম পাঠিয়েছি, কেউ এমন অভিযোগ করেনি।আরেক আম বিক্রেতা আশফাকুর রহিম বলেন, ‘আমার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। ঢাকায় পড়াশোনা করি। পাঁচ বন্ধু মিলে মৌসুমি আমের ব্যবসা করি। এবার আম পাঠানো শুরু করেছি।আমের সাইজ ও রঙ বেশ ভালো, যে কেউ পছন্দ করবে। কিন্তু স্বাদ নিয়ে অভিযোগ আসছে।’স্থানীয় চাষি ও বিক্রেতারাও জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে রংপুরের আঁশবিহীন সুমিষ্ট হাঁড়িভাঙ্গা আমের স্বাদে কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। বড় এবং মাঝারি সাইজের আম কিছুটা পানসে লাগছে।রংপুরের বিভিন্ন হাটে, বাজারে, রাস্তার মোড়ে রিকশা, ভ্যান, বাইসাইকেলে করে চাষি ও ফড়িয়ারা আম বিক্রি করছেন।তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাজারে ভিড় কম। দাম কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন চাষি ও বাগান মালিকরা। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে আঞ্চলিক অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাদ কমে যাওয়ার কারণের মধ্যে আছে নিচু জমিতে বাগান করা, বর্ষায় গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকা, ইউরিয়া সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং ‘কালটার্ড’ নামে হরমোন প্রয়োগের প্রবণতা।একই সঙ্গে জেলিসিডের (আমের আঁটির গোঁড়ায় দ্রুত পচন) কারণে আম দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৩ মে রংপুরের বুড়িরহাট কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে এক কর্মশালায় হাঁড়িভাঙ্গা আমের ‘সেলফ লাইফ’ (দীর্ঘদিন ভালো রাখা) নিয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। সেখানে রংপুর অঞ্চলের কৃষি ও বিপণন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।এ বছর রংপুরের মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ, সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় ১ হাজার ৯১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২৯ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন। গড়ে প্রতি কেজি ৬০–৭০ টাকা দরে বিক্রি হলে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ ও বিপণন প্রতিবছরই বাড়ছে। দেশের অন্য প্রান্তেও এর চাষ শুরু হয়েছে।গতকাল শনিবার পদাগঞ্জের সবচেয়ে বড় আমবাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত বছর যে আম মণপ্রতি ১৮০০–২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, তা এবার ১২০০–১৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য বছর যে হারে ফড়িয়া ও মৌসুমি উদ্যোক্তারা আসতেন এবার অনেকটাই কম। কেজিপ্রতি ৩০–৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।বাগান মালিকদের অভিযোগ, গরমের কারণে এবার আম বাজারে এসেছে অনেক আগে। প্রতি বছর সরকারিভাবে ১৫–২০ জুন আম বাজারে আনা হতো। এবার এখনও বাইরের পাইকার ঠিকমতো আসেননি।মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ এলাকায় দেখা গেছে, উঁচু জমি, বাড়ির আঙিনা, রাস্তার ধারে সারি সারি আমগাছ ছাড়াও বিস্তীর্ণ নিচু জমি ও ধানের জমির আইলেও বাগান করা হয়েছে।বাজারে ছোট সাইজের আম মণপ্রতি ৮০০–১০০০ টাকা, মাঝারি সাইজের ১১০০–১৪০০ টাকা এবং বড় সাইজের ১৬০০–২২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। চাষিরা আশা করছেন, দাম আরও বাড়বে।আমচাষি মকবুল হোসেন বলেন, ‘এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। আম ভালো ধরেছে। তবে গাছের যত্ন, ওষুধ দিতে খরচ বেশি পড়েছে। একটু দাম না পেলে লাভ হবে না, কিন্তু দাম কম।’চাষি আবদুল ওয়াহাব মিয়া বলেন, ‘গত বছর মৌসুমের শুরুতে যে আম ছিল ১৪০০–১৬০০ টাকা মণ, এবার সেটা ১১০০–১২০০ টাকা। শুনছি দাম বাড়বে।’মৌসুমি বিক্রেতা রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল ২৮০ কেজি ঢাকায় পাঠিয়েছি। আজ দেড়শ মণ অর্ডার আছে। বাজার কিছুটা কম। স্বাদ নিয়ে অভিযোগ আসছে, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।’বাগান মালিক মহুবর রহমান মন্তা বলেন, ‘আগে নিচু জমিতে আম চাষ হতো না। এখন ধানের জমিতে যেখানে বর্ষায় পানি জমে সেখানেই বাগান হচ্ছে। সেই আমের স্বাদ কম। উঁচু লাল মাটির জমির আম সুস্বাদু। কেনার সময় দেখে শুনে কিনতে হবে।’চাষি আমজাদ হোসেন বলেন, ‘এই আম পাকলে তিন দিনও থাকে না। তখন দাম থাকে না। ৫ টাকা কেজিতেও কেউ নেয় না। শুধু দ্রুত পাকতে থাকে।’চাষি নয়া মিয়া বলেন, ‘বাড়ির গাছের আম পাকলে অনেক দিন খাওয়া যায়। যত পাকে তত মজা। কিন্তু হাঁড়িভাঙ্গা দিয়ে হয় না, বেশি পাকলে আর খাওয়া যায় না, ফেলে দিতে হয়।’রংপুর বুড়িরহাট কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এই আমের প্রধান সমস্যা জেলিসিড। এটি হলে আঁটির চারপাশের মাংস গলে যায়। আমরা গবেষণায় পেয়েছি, আঁশযুক্ত আমে জেলিসিড কম হয়। ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়াম কমে গেলে জেলিসিড হয়। কৃত্রিমভাবে এ দুটি উপাদান সরবরাহ করে জেলিসিড কমানো যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে।’তিনি আরও জানান, বারি–৪ ও সুর্যাপুরি জাতের সঙ্গে হাঁড়িভাঙ্গা মিশিয়ে হাইব্রিড করা যায় কি না, সেটিও বিবেচনায় আছে। জেলিসিড নিয়ন্ত্রণে ইউরিয়া কমানো, জৈবসার বাড়ানো, কৃত্রিমভাবে ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়াম দেওয়া, লাল মাটিতে চাষ করা এবং বর্ষায় পানি দ্রুত নিষ্কাশনের পরামর্শ দেন তিনি।রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘হাঁড়িভাঙ্গা সুস্বাদু ও মাংস বেশি। কিন্তু পাকলে সর্বোচ্চ তিন দিন থাকে। এরপর খাওয়া যায় না। তাই রপ্তানিকারকরা ভয় পান। সেলফ লাইফ বাড়ানোর দ্রুত গবেষণা দরকার। কারণ এই আমের কারণে এই অঞ্চলের অনেকের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরেছে। তাতে ধাক্কা লাগলে অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়বে।’রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তা শাহীন আহমেদ বলেন, ‘এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৯ হাজার ৮৫১ টন। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে তা পূরণ হবে। চাষিরা যাতে বিক্রি করতে অসুবিধায় না পড়েন, সে জন্য সারা দেশের প্রায় একশ ফল ব্যবসায়ীর মোবাইল নম্বর লিফলেট আকারে বিতরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারও ধরার চেষ্টা চলছে।’