মাছের মেলা বা জামাই মেলা হিসেবে ক্ষেতি উত্তরাঞ্চলে
নিত্য নিউজ ডেস্ক:
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পোড়াদহ এলাকার নামানুসারে এ মেলার পরিচিতি পোড়াদহ মেলা হিসেবে।
প্রায়৪শ বছর পূর্বে ইছামতি নদীর কোলঘেষে সাধুসন্নাস্যির আস্তানা ছিল ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ এলাকায়। পরবর্তীতে মন্দির গড়ে উঠে এ স্থানে। তখন থেকে মাঘ মাসের শেষ বুধবারে সাধু সন্নাসী পূজা উপসনা করে। বসে দিনব্যাপি মেলা। এ মেলায় ভীর জমান উত্তরাঞ্চলের সবধর্ম বর্ণের মানুষ। এলাকার জামাই মেয়ে আসেন মেলা উপলক্ষে। এটি সার্বজনীন গ্রামীন লোকজ উৎসব হিসেবে উদযাপন করেন সবাই। তবে এ মেলার প্রধান আকর্ষন বড় আকৃতির মাছ। মাছ ছাড়াও সংসারের প্রয়োজনীয় সব ধরনের জিনিষ মিষ্টি মিষ্টান্ন ও খেলা ধুলার নানা আয়োজন মেলাকে প্রানবন্ত করে তোলে সব বয়সের নর নারীর।
বুধবার সকাল থেকেই শুধুমাত্র আশপাশের গ্রামে নয় পূর্ব বগুড়ার প্রায় পাঁচটি উপজেলার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বসেছে মাছ ও মিষ্টির দোকান। জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পোড়াদহ মেলার আমেজ। মেলার প্রধান আকর্ষন মাছ আর মিষ্টি এই দুইয়ের সমন্বয়ে আবার মাছ মিষ্টি।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে মাঘ মাসের শেষ বুধবার আয়োজন করা হয় এ মেলার। স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৪০০ বছর আগে এই স্থানে একটি বট গাছ ছিলো। একদিন হঠাৎ করেই সেখানে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয়। তারপর সেখানে দলে দলে সন্ন্যাসীরা এসে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে জায়গাটি পূণ্য স্থানে পরিণত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবারে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে। আর এই সন্নাসী পুজাকে ঘিরেই এই মেলার উৎপত্তি। এক সময় সন্ন্যাসীরা স্থানটি ত্যাগ করে চলে গেলেও সন্ন্যাসী পূজাটি অব্যাহত থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মেলার পরিচিতি বাড়তে থাকে।
মেলায় আসা মহিষাবান ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুস সালাম জানান, মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবে জামাই-মেয়েসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত না দিলেও তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে মেলা উপলক্ষে দাওয়াত দিতেই হবে, যা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে এলাকার প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এসেছে। মেলার কয়েক দিন পর্যন্ত আত্মীয় স্বজনের ধুমধাম চলবে। মেলাটি একদিনের হলেও অত্র এলাকায় মেলার আমেজ থাকে সপ্তাহ ব্যাপী।
বাঙ্গালী মাছে ভাতে তাই মাছ নিয়ে অন্যরকম এক আবেগ আছে বাঙ্গালীর মাঝে। রুই, কাতলা, বোয়াল, চিতল পাঙ্গাশসহ হরেক রকমের মাছ ওঠে এই মেলায়। ২০২২ সালের আগে পর্যন্ত মেলায় সবচেয়ে বড় মাছের তালিকায় নাম থাকতো বাঘাইড়ের। মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণী বলে ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ হলেও এবছর এমেলায় ছোট ও মাঝরি আকৃতির বাঘাআইড় মাছের দেখা মিলেছে।
মাছ বিক্রেতা আব্দুল লতিফ বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর যাবত এই মেলায় দোকান বসায়। সপ্তাহখানে আগে আমরা এই জায়গা নির্ধারন করেছি। এই মেলাকে ঘিরে প্রায় সপ্তাহ আগে থেকে আমরা মাছ সংগ্রহ করি। বগুড়ার স্থানীয় নদী সহ দেশের বিভিন্ন আরত হতে মাছ ক্রয় করে মেলায় বিক্রি করি।
তিনি আরো বলেন, আমি ৭ থেকে ১০ কেজি ওজনের সিলভার বিক্রি করছি ৪০০ টাকা কেজি প্রতি। ৪থেকে ৫ কেজি ওজনের রুই ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজিতে।
এছাড়াও এই মেলায়, কাতলা প্রতি কেজি ৬শ থেকে ৭শ, বোয়াল ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা, চিতল প্রতি কেজি ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা এবং বাঘাআইড় প্রতি কেজি ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।
মেলা উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি ঘুরতে আসা নতুন জামাই রফিক জানান, আমার বাড়ি দিনাজপুর শহরে। আমি এই প্রথম মেলাতে এসেছি। এই পোড়াদহ মেলাতে আসার আগে মেলা সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি তা আজ বাস্তবে দেখলাম। সকালে আমার শ্বশুর আমাকে মেলা উপলক্ষে ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। আমি মেলায় এসে কাতলা মাছ কিনেছি ১২ কেজি ওজনের।
ঠাকুরগাঁ থেকে ঘুরতে আসা একটি পরিবার জানান, এত মাছ একসাথে দেখব কখনো ভাবিনি। আমি আমার শ্বশুর শাশুড়ি ছেলে মেয়েসহ সবাই ঘুরতে এসেছি এ মেলায়। খুব ভালো লাগছে মেলা ঘুরে। তাদের ভিতর প্রবীণ একজন জানান, আমার বয়স ৯৬ বছর চলে, আমি সর্বশেষ ৭০ বছর আগে পোড়াদহ মেলায় এসেছিলাম। আগে এই পোড়াদহ মেলাএই পোড়াদহ স্থানেই হতো আরো বড় পরিসরে। এখন এই মেলাটি পুরো বগুড়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে আসার আগে আমি আরো ২ টি মেলা ঘুরে এখানে এসেছি৷ প্রায় ১৫ তেকে ২০ গ্রাম নিয়ে এ মেলা হত, এখানে ঘোড়া দৌড়সহ বিভিন্ন গ্রামীণ সংস্কৃতির অনুষ্ঠান হতো। এখন জমিতে চাষাবাদ ও জায়গা সংকটের কারণে মেলাটি বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। আমরা মাছ কিনেছি এখন মিষ্টি কেনার জন্য যাচ্ছি।
এ দিকে মিষ্টির প্রতি আকর্ষন বাড়াতে মাছের আকৃতিতে মিষ্টি তৈরী করেছেন এখানকার কারিগররা। এমেলায় সবচেয়ে বড় মিষ্টি উঠেছে ১৫ কেজি ওজনের, যা বিক্রি হয়েছে ৯ হাজার টাকায়। এছাড়াও ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের মাছ আকৃতির মিষ্টির সহ সাদা মিষ্টি, কালো মিষ্টি, গোলাপ জাম, পান্তুয়া, মরিস মিষ্টি সহ আরেক রকমের মিষ্টি উঠেছে এই মেলায়। এ মেলায় ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে মিষ্টি।
মিষ্টি বিক্রেতা শমসের ঘোষ জানান, আমরা প্রায় ১০ দিন আগে থেকে মিষ্টি তৈরি করছি। দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ আমি মেলায় মিষ্টির দোকান করি। মিষ্টি চাহিদা এত বেশি থাকে যে আমরা এখানে মিষ্টি তৈরি করেও ক্রেতাদের যোগান দিতে পারি না। আশা করছি এবার প্রায় ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকার মিষ্টি বিক্রি হবে। অনেক রকম মিষ্টি থাকলেও মাছ আকৃতির মিষ্টি চাহিদা বেশি এই মেলায়।
মেলায় আসা ফরিদউদ্দিন জানান, মেয়ে জামায় সহ আত্মীয়-স্বজনরা বাসায় এসেছে। সকালে মাছ কিনেছি এখন মিষ্টি নিতে এসেছি এখানে। ভাবছি একটি বড় আকৃতির মাঝে মিষ্টি নিব এবং পাঁচ কেজি গোল মিষ্টি নিব। শুধু আমি না আশেপাশে দুই চার গ্রামের মানুষ মেলা উপলক্ষে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় নিমন্ত্রণ করেছে।
গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে জামাই এসেছে। মেলার বেশির ভাগ মাছই কেনেন জামাইরা। তাছাড়া বড় বড় মাছ দেখেশুনে কিনতে মেলায় আগমন ঘটে নারীদেরো। এ দিকক মেলার খ্যাতি ছড়িয়ে আছে জেলার বাইরেও, তাই দুর দুরান্ত থেকে মেলায় আসেন অনেকেই। তাদের খাবারের প্রয়োজনে মেলার ভেতরে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য হোটেল।
উত্তরের জেলাগুলোতে বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে পোড়াদহ মেলার। পূজা-পার্বণ মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও মেলাটি এখন সার্বজনিন উৎসবে রূপ নিয়েছে। জেলা জুড়ে বইছে উৎসবের আমেজ। কাল বসবে বউ মেলা। এ মেলাতে শুধু নারী ও এলাকার বউরা এ মেলায় আসেন।