সংসদে হযরত শেখ হাসিনা বলে তেলবাজীর মহানায়ক ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কটুক্তিকারী হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন টোকাই থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক। ৫ আগষ্টের পর তার আর হদিস মিলছে না। নামে বেনামে এত শত কোটি টাকার অনুসন্থানেও খোঁজ রাখছে না দুদক।
বিস্তারিত মাজেদ রহমানের প্রতিবেদনে:
সভা–সমাবেশে বক্তব্য দিতে উঠলে আবু সাঈদ আল মাহমুদ বলতেন, তিনি খাদেম হয়ে মানুষের সেবা করতে চান। কিন্তু গত ১৬ বছরে টানা তিনবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য নিজের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো জেলা। হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা। তাঁর বিপক্ষে কেউ কথা বললেই নানা নির্যাতন নেমে আসত বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
আওয়ামী লীগ সরকারে পুরোটা সময় যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছিলেন আবু সাঈদ আলম মাহমুদ (স্বপন)। ‘চেরাগে ঘঁষা’ দিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তাঁর স্ত্রী মেহেবুবা আলমও একসময় শুন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন। ইতিমধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আবু সাঈদ আল মাহমুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। তবে এই মুর্হুতে আবু সাঈদ আল মাহমুদ দেশে আছেন নাকি পালিয়ে ভারতে তা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক পরির্দশক শাহেদ আল মামুন বলেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে জেলায় একাধিক মামলা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন। এ সময় তিনি ঘনিষ্ঠ অনেকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছেন। পুলিশ তাঁকে খুঁজছে।
দলের নেতা–কর্মীরা বলছেন, ২০০৮ সালেও বছরে ৪ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছিলেন আবু সাঈদ। তখন নির্বাচনের অনেক খরচ দলীয় নেতা–কর্মীরাই মিটিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয় এক কোটি ১৪ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিংবা পরিচালক হওয়ার সুবাদে তাঁর ব্যাংক ঋণ সাড়ে সাত শ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের জম্মভিটা জয়পুরহাট-১ আসনের পাঁচবিবি উপজেলায়। দলীয় নেতা-কর্মীরা বলেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদের বাবা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্মচারী ছিলেন। এক সময় তাঁর বাবা নওগাঁয় চাকরি করতেন। আবু সাঈদ নওগাঁ সরকারি কলেজে ভর্তির পর ছাত্রলীগের রাজনীতি জড়িয়ে পড়েন। এইচএসসি পাস করে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর তিনি ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক। পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ও সহসভাপতি হন। এসময় তিনি দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নজরে আসেন।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়পুরহাট-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবু সাঈদ। নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী গোলাম মোস্তফার কাছে পরাজিত হন। নির্বাচনের কয়েক মাসের মাথায় আবু সাঈদ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম সংসদ সদস্য হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় জাতীয় সংসদের হুইপ হন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর দ্বিতীয় বারের মতো হুইপের পদ পান।
দলের কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার সুবাদে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবু সাঈদ আল মাহমুদ। তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবী পেতেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও তাঁরা দলের সমর্থন পেতেন। কিন্তু তাঁর বিপক্ষে কথা বললে নানা নির্যাতন নেমে আসতো বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী নেতা-কর্মীরা।
এক সময় আল মাহমুদের ঘনিষ্ট ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরী। একপর্যায়ে বনিবনা না হওয়ায় আল মাহমুদের থেকে সরে যান গোলাম মাহফুজ। এরপর গোলাম মাহফুজ ও তাঁর স্ত্রী কামরুন্নাহার শিমুলের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী কারাগারেও ছিলেন। এসব মামলার পেছনে আল মাহমুদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে অভিযোগ করেছেন গোলাম মাহফুজ।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ন ম শওকত হাবিব তালুকদার কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউপির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে আমার নামে ১৩টি মামলা দেওয়া হয়েছে। শুধু সাবেক হুইপের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার প্রতিহিংসায় আমার বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়েছে। যেসব দলীয় নেতারা সাবেক হুইপকে তোষামদি জ্বি ভাই, হ্যাঁ ভাই বলতেন তাঁরাই ভালো পদ পেতেন আবার ভালো থাকতেন। যেসব দলীয় নেতা-কর্মী তাঁর বিপক্ষে গেছেন তাঁরা হামলা আর মামলা উপহার পেয়েছেন।’ তিনি অভিযোগ করেন, আবু সাঈদ এলাকার অনেক টোকাইদের দলীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে বসিয়ে পূর্নবাসন করেছেন। ওর্য়াডের মেম্বার নির্বাচনে ভরাডুবি হবে এমন ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন।
তাইফুল ইসলাম তালুকদার ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ক্ষেতলাল উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতাও। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আল মাহমুদকে ক্ষেতলাল খবরদারি করতে দেননি। এ কারণে তাঁরই পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাকিম মন্ডলকে ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছিলেন।
তাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যখন দলের সুসময় ছিল তখনও আমরা নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এখন দলের দুঃসময়ে আমরাই নির্যাতিত হচ্ছি। আবু সাঈদ আল মাহমুদ দলের সুদিনের মধু খেয়ে এখন লাপাত্তা। জয়পুরহাটের আওয়ামী লীগ ধ্বংস করেছেন তিনি।’
আবু সাঈদ আল মাহমুদ এলাকার মানুষের কাছে নিজেকে সংসদ সদস্য নয় ‘খাদেম’ (সেবক) বলে পরিচয় দিতেন। সভা-সমাবেশে নরম সূরে ও ভদ্র ভাষায় কথা বলে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তবে আড়ালে তাঁর চেহারা ছিল আলাদা। তাঁর বিপক্ষে গেলেই গালাগাল ও বাজে আচরণ করতেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৫ আগস্টের পর ফেসবুকে আবু সাঈদের গালাগালের একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। ওই অডিও ক্লিপটি জয়পুরহাট শহরের জানিয়ার বাগানে মহল্লার বাসিন্দা ঠিকাদার জাহিদুল ইসলামকে গালাগালের বলে জানা গেছে। জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কালাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে মেশিন সরবরাহের কাজ পেয়েছিলাম। সরবরাহের সময় থাকতে স্বপন সাহেব আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগলাজ করেছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জয়পুরহাট সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, ‘সাবেক হুইপকে তাঁর বাসায় ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী খেলার দাওয়াত কার্ড দিতেগিয়েছিলেন। তখন তিনি দলীয় এক নেতাকে গালাগালি করেন। তাঁর সঙ্গে দেখে তিনি আমাকেও ছাড় দেননি। তাঁর বাজে আচরণ ও গালাগালে হতভম্ব হয়েছি।’
স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গেও একই ধরনের আচরণ করেছেন। জয়পুরহাট প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, গত সংসদ নির্বাচনের আগে এক সাংবাদিক আবু সাঈদের হলফনামা নিয়ে অনলাইন পোর্টালে সংবাদ করেছিলেন। ওই সংবাদে একটু ক্রুটি ছিল। দ্রুত তা সংশোধনও করা হয়। নির্বাচনের পর ওই সাংবাদিকসহ ১০-১২ তাকে শুভেচ্ছা জানাতে বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে ওই সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালিগলাজ করেছিলেন আবু সাঈদ আল মাহমুদ।
ভুক্তভোগী ওই সাংবাদিক বলেন, ‘স্বপন সাহেব নিজেকে খাদেম বলে পরিচয় দিতেন। তিনি বাইরে নিজেকে ভালো জাহির করতেন। কিন্তু তাঁর ভেতর চেহারা নিকষ কালো। তিনি কাউকে মানুষ মনে করতেন না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ায় আবু সাঈদ আল মাহমুদ জয়পুরহাটে তেমন অবস্থান করতেন না। তবে জয়পুরহাটে তাঁর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ছিল। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য জয়পুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া দোগাছি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম, কলেজশিক্ষক মাসুদ রেজা, কালাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান, ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাকিম মন্ডল, আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোকছেদ আলী মাস্টার, পাঁচবিবি পৌরসভার সাবেক মেয়র হাবিবুর রহমান, আক্কেলপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহসান কবির, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাসেল দেওয়ান মিলন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কালীচরণ আগরওয়ালাও এই সিন্ডিকেটের অংশ ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত সংসদ নির্বাচনের পর আহসান কবির সিন্ডকেট থেকে বেরিয়ে যান। ৫ আগস্টের পর সিন্ডিকেটের সদস্যরাও আত্নগোপনে চলে গেছেন।
দলীয় নেতা-কর্মী ও স্থানীয়রা বলছেন, এই সিন্ডিকেট গত ১৬ বছর ধরে নির্বাচনী এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরি নিয়োগ, মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য করেছ। জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেছে। আবু সাঈদের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী মেহেবুবা আলমও ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জেলার সবচেয়ে বড় পশুরহাট জয়পুরহাট পৌরসভা নিয়ন্ত্রণাধীন নতুনহাট। সপ্তাহে একদিন শনিবার পশুর হাট বসে। প্রতি শনিবারে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার গরু ক্রয়-বিক্রয়। প্রতি বছর হাটটি ইজারা পেতেন কালীচরণ আগরওয়ালা।
জয়পুরহাটের ঠিকাদার জহুরুল ইসলাম বলেন, সাবেক হুইপের ঠিকাদারি সিন্ডিকেট দেখতেন প্রভাষক মাসুদ রেজা। গত কয়েক বছর ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশলী যত বড় বড় কাজ প্রভাষক মাসুদ রেজা, কালীচরণ আগরওয়ালা করেছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে জেলার চারটি নদী ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, হারাবতি ও চিড়ি পুনঃখনন ও বাঁধ নির্মাণ কাজ ২০২২ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। আবু সাঈদের তদবিরে প্রকল্পগুলো এসেছিল। কাগজে-কলমে ঢাকা, নাটোর, ফেনী, বরগুনা পটুয়াখালী, রংপুর, খুলনার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। তবে এসব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কেউ কাজ করেননি। কলেজশিক্ষক মাসুদ রেজা কাজগুলো বাস্তবায়ন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জয়পুরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা তো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল দিয়েছি। কাজেই স্থানীয়ভাবে যদি কেউ ঠিকাদারি করে থাকে তাহলে সেটা আমার বলাটা সঠিক হবে না।’
ক্ষেতলাল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুজ্জামান নাদিম বলেন, আবু সাঈদ আওয়ামী লীগকে কোনঠাসা করে রেখেছিলেন। যারা ভাইলীগ করতেন তাঁরাই ভালো থাকতেন। দলীয় মনোনয় বাণিজ্যে হয়েছে। আবু রাশেদ আলমগীর দলীয় কোনো পদে ছিলেন না। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আবু রাশেদ আলমগীরকে বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদ দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দিয়ে চেয়ারম্যান বানানো হয়েছে। এরকম অনেক মনোনয়ন বাণিজ্য করা হয়েছে।
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সংসদ সদস্য হওয়ার সুবাদে নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলার চারটি বেসরকারি কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। এগুলো হচ্ছে আক্কেলপুর এমআর ডিগ্রি কলেজ, ক্ষেতলাল ছাইদ আলতাফুন্নেছা ডিগ্রি কলেজ, কালাই ডিগ্রি কলেজ ও কালাই মহিলা ডিগ্রি কলেজ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শিক্ষক–কর্মচারী নিয়োগে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কালাই ডিগ্রি কলেজের শিক্ষকেরা বলেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদ তাঁদের জাতীয়করণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শর্ত অনুযায়ীও জাতীয়করণ হওয়ার কথা। কিন্তু পরে কালাই মহিলা ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণ হয়। এমন অবস্থায় আল মাহমুদের অনুসারী কালাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমানের নির্দেশে জাতীয়করণ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। মিনফুজুর কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর মামলা পরিচালনার খরচার নামে কমিটি করে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে দেড় কোটি আদায় করা হয়। কলেজ জাতীয়করণ হয়নি। মামলার ফলাফলেরও অগ্রগতি নেই।
কালাই ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল্লা আল মজিদ বলেন, ‘আমি নিজে আমার ভাগের দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি। আমার মতো ৭০ জন শিক্ষক কর্মচারীরা সবাই টাকা দিয়েছেন। জাতীয়করণের নামে কৌশলে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ কলেজের সদ্য অবসরে যাওয়া অধ্যক্ষ ধজেন্দ্র নাথ দাস বলেন, সেই সময় শিক্ষক-কর্মচারীরা সবাই মিলে কোটি টাকার ওপরে দিয়েছিলেন।
ক্ষেতলাল ছাঈদ আলতাফুন্নেছা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. ঈদ্রীস আলী বলেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদ কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি থাকার সময় ১৭ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। সেই সময় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা কলেজে টাকা ডোনেশন (অনুদান) দিয়েছিলেন। সেই টাকায় কলেজের সভাপতি কলেজে বাস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বাস কিনতেও গিয়েছিলেন। ঘটনার ৭-৮ বছর হচ্ছে কলেজে এখনো বাস আসেনি। টাকারও হদিস নেই।
জয়পুরহাট সরকারি কলেজ সংলগ্ন ও রেলস্টেশনের পশ্চিম দিকে শহরের শান্তিনগর মহল্লায় আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের এক বিঘারও বেশি আয়তনের একটি বাসা রয়েছে। এই বাসাটি পুরোটায় সাদা রঙের হওয়ায় ‘হোয়াইট হাউজ’ বলে এলাকার লোকজন চিনেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ‘হোয়াইট হাউজ’ ধ্বংসস্তুপে পরিনিত হয়েছে। লুটপাটের পর হোয়াইট হাউজ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষুব্ধ লোকজনেরা হোয়াইট হাউজের একটি দরজা-জানালাও রাখেননি। এখন হোয়াইট হাউজর মূল ফটক টিনের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, হোয়াইট হাউজ নির্মাণের আগের জায়গাটি জয়পুরহাট সরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ জায়গাটি অধিগ্রহন করতে চেয়েছিল। আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বিষয়টি জানতে পারেন। একারণে সরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ জায়গাটি আর অধিগ্রহন করতে পারেনি। উল্টো প্রভাব খাটিয়ে কলেজের অধিগ্রহন করা কিছু জায়গা হোয়াইট হাউজের সীমানা প্রাচীরের ভেতর ঢুকে নিয়েছেন। খোকা উড়াও নামে এক আদিবাসী পরিবারকে কৌশল উচ্ছেদ করে জায়গা দখল করার অভিযোগ রয়েছে। হেয়াইট হাউজ বাসার জায়গার কিছু অংশের মালিক ছিলেন স্বপ্ন ছায়ার কমিউনিটি সেন্টারের মালিক তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাবেক হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন প্রথমে আমার ভাই লায়েক আলীর কাছে জমি কিনেছিলেন। এরপর আমার অংশের প্রতি শতক সাড়ে নয় লাখ টাকা করে বিক্রি করেছি। তবে জমিটি আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের নামে রেজিষ্ট্রি হয়নি। কত শতক বিক্রি করেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সঠিক মনে নেই। তবে ১৫-১৬ শতক হতে পারে। আদিবাসী খোকা উড়াওয়ের ছেলে গণেশ উড়াও বলেন, আমাদের বাসার উত্তর পাশে স্বপন সাহেব বাসা করেন। একদিন বাসায় এসে দেখি আমাদের বাসাটি টিন দিয়ে ঘিরে স্বপন সাহেবের বাসার জায়গার ভেতর নিয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করলে স্বপন সাহেবের কয়েকজন এসে ভয়-ভীতি দেখায়। পরে আমাদের পরিবার থেকে একজন চাকরি দেবে আশ্বাস দিয়েছিল। এরপর দোগাছি ইউপির সেই সময়কার চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম আমাদের তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এরপর আমরা অন্যত্র গিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করছি। এ প্রসঙ্গে স্বপ্নছায়ার মালিক তরিকুল ইসলাম বলেন, আদিবাসী পরিবার বসবাস করছিলেন ঠিকই। তবে তাঁদের কোন জমির কাগজপত্র ছিল না। মুলত আমাদের জমিতে তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল। আমরা আদিবাসীদের সরানোর চেষ্টা করিনি। হঠাৎ করেই একদিন দেখি আদিবাসীরা এখান থেকে চলে গেছেন। জয়পুরহাট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, হোয়াইট হাউজের প্রাচীর সোজা করতে গিয়ে কলেজের কিছু জায়গা ভেতরে ঢুকে নেওয়া হয়েছে। আমরা এখন জায়গার মাপজোক করিনি। একারণে দখলকৃত জমির পরিমাণ সঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে খুব শিগগিরই মাপজোক করে হোয়াইট হাউজের ভেতরে থাকা কলেজের জায়গা বের করে নেব। আমরা সেই সময় বাঁধা দিতে পারিনি। কারণ, তখন আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ছিলেন সরকার আর আমরা সরকারের কর্মচারী। যেহেতু হোয়াইট হাউস এখন পরিত্যক্ত। আমরা জায়গাটি অধিগ্রহনের জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছি।
নিজের স্বীকারোক্তিতে সম্পদের বিবরন:
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ২০০৮ সালেই লাখপতি ছিলেন। তাঁর স্ত্রী কোন সম্পদ ছিল না। গত ১৬ বছরের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন আয়-ব্যবসা বেড়ে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তাঁর স্ত্রীও শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছে।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় ব্যবসায় ও মৎস্য চাষে তাঁর বাৎসরিক মোট আয় ছিল মাত্র তিন লাখ ৯৫ হাজার। নগদ পাঁচ লাখ টাকা ছিল। সেটিও রানিং ব্যবসায় লাগান। স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের নামে কোন অস্থাবর সম্পদ ছিল না। স্থিবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে ১০০ শতাংশ কৃষি জমি ছিল। তাঁর মুল্য ছিল মাত্র সাড়ে একুশ হাজার টাকা। অকৃষি জমির ছিল ৫.৫০ শতাংশ। যার মূল্যে ছিল সাড়ে সতের হাজার টাকা। তখন স্ত্রী ও নির্ভরশীল নামে কোন স্থাবর সম্পদ ছিল না। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবু সাঈদ আল মাহমুদের হলফনামা বলছে, তাঁর বার্ষিক আয় এক কোটি ১৪ লক্ষ ৬০ হাজার ৩৫২ টাকা ও নির্ভরশীলদের আয় ২৪ লক্ষ ৫ হাজার ৮৪ টাকা। নগদ টাকা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও স্ত্রীর নগদ ১ লাখ টাকা।
অস্থাবর সম্পদে রয়েছে এক কোটি ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৮২০ টাকা। আর তার স্ত্রীর রয়েছে ৫৬ লক্ষ ৩৬ হাজার ৯৩২ টাকা। স্থাবর সম্পদে পূর্বের ১০০ শতাংশ ও সাড়ে ৫ শতাংশ জমির সাথে সাড়ে ৭৪ শতাংশ অকৃষি জমি যোগ হয়েছে। এর দাম ১৬ লক্ষ ২৬ হাজার ৯৩১ টাকা। ঢাকার পূর্বাচলে সাড়ে ৭ কাঠা জমির দাম ধরা আছে ২১ লক্ষ টাকা। আবার ২ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। তার স্ত্রীর স্থাবর সম্পদ রয়েছে ৭ লক্ষ টাকার ৩০.৪০ শতাংশ কৃষি জমি। ১৬ লক্ষ ২৬ হাজার ৯৩১ টাকার ৭৪.৭৫ শতাংশ অকৃষি জমি। সেই সাথে ঢাকার সাভার এলাকায় ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকার ৫ শতাংশ জমি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৫ কাঠা জমি কেনার জন্য ৭৫ লক্ষ টাকা বায়না দেওয়া রয়েছে। এছাড়া জয়পুরহাট শহরের শান্তিনগর এলাকার সেই বাড়িটি নির্মাণে ব্যয় ধরা আছে ৬২ লক্ষ টাকা এবং এক কোটি ৫ লক্ষ টাকার ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম দেওয়া আছে। নির্ভরশীলদের নামে পেঁচুলিয়া মৌজায় এক কোটি ২৬ লক্ষ ৭০ হাজার টাকায় ৩৭৪.৪০ শতাংশ কৃষি জমি এবং জয়পুরহাট মৌজায় এক কোটি ৫৩ লক্ষ ৯২ হাজার টাকার ২২.৮৫ শতাংশ অকৃষি জমি রয়েছে। যৌথভাবে বা নির্ভরশীল সদস্যের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা ডিরেক্টর হওয়ার কারণে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৭৬৪.২৪ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। তবে হলফনার বাহিরে তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের নামে আরও সম্পদ থাকার কথা শোনা যাচ্ছে।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরী বলেন, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আবু সাঈদ প্রথম দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলন। তখন তাঁর তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। সেই সময় দলীয় নেতা-কর্মীরা নিজেরাই টাকা-পয়সা তুলে নির্বাচনের খরচ চালিয়েছেন। এখন আবু সাঈদ আল মাহমুদ শত শত কোটি টাকার মালিক। মাত্র ১৬ বছরে তিনি কীভাবে এত টাকার মালিক হলে সেটি সবাই কম-বেশি জানেন।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হারলেও তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। তখন আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতা বনে যান তিনি। এরপর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়, ভোটারবিহীন ও সাজানো নির্বাচনে পরপর টানা তিন বার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যায় দুই দফায় জাতীয় সংসদের হুইপও ছিলেন। তিনি হলেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। জয়পুরহাট জেলা তিনটি উপজেলা আক্কেলপুর-কালাই-ক্ষেতলাল নিয়ে গঠিত জয়পুরহাট-২ আসন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার বারের পুরোটা সময় তিনি ক্ষমতাবান ছিলেন। সংসদ সদস্য পদে হেরে আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতার দাপট দেখিয়েছেন। এরপর টানা তিন বার একই সঙ্গে সংসদ সদস্য, হুইপ আবার কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দাপট দেখিয়েছেন।
(প্রতিবেদনে অনেক তথ্য উপাত্ত সহকর্মি রবিউল ইসলাম, প্রথম আলো জয়পুরহাট প্রতিনিধির কাছ থেকে নেওয়া)